কাগজপত্রের সত্যায়ন ভোগান্তি :এটা কি সত্যায়ন, নাকি জীবনের মহাকাব্য?

কাগজপত্রের সত্যায়ন শুধু একটা শব্দ নয়, বরং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য এটি এক মহাকাব্যিক যাত্রার নাম! 



বাংলাদেশে কাগজপত্রের সত্যায়ন মানেই যেন এক মহাকাব্যিক অভিযান, 

যেখানে সময়, শ্রম, এবং কখনো কখনো পকেটেও ছিড়ে যায়! স্বাধীনতার এত বছর পরও এই প্রক্রিয়া যতটা ঝামেলাপূর্ণ ছিল, এখনও ততটাই রয়ে গেছে। "গেজেটেড অফিসারের কাছে যাবো!" এই কথা বললেই যেন এক অজানা গ্রহে পাড়ি দেওয়ার কল্পনা আসে। কারণ গেজেটেড অফিসারের কাছে পৌঁছাতে হলে, একেবারে সময়ের মধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়, আর কখনো কখনো সঠিক অফিসারের দেখা মেলেও না।


কাগজপত্রের সত্যায়ন শুধু একটা শব্দ নয়, বরং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য এটি এক মহাকাব্যিক যাত্রার নাম! এটাই যেন কোনো অলৌকিক প্রক্রিয়া, যেখানে একে একে আপনার সাহসিকতার পরীক্ষা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে, আপনি সিদ্ধান্ত নেন যে কাগজপত্রটা সত্যায়িত করবেন। কিন্তু এর পরের পর্যায়টায় আপনি বুঝতে পারেন এটা আরেকটি "রোলার কোস্টার রাইড"!


এখন প্রশ্ন, কেন কাগজপত্র সত্যায়ন এত কঠিন? যে সহজ কাজটা করতে, আপনি একজন সরকারি অফিসারের কাছে গেলে আপনাকে বসতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যদিও সেই অফিসার হয়তো একেবারে হাওয়া হয়ে যান! এবং যদি আপনি ‘অফিসারের সাথে পরিচিত’ হন, তবে তার সিলের চেয়ে বড় সিল কী আর হতে পারে! যদি পরিচিতি না থাকে, তবে দালালরা এসে হাজির! আর সেই দালাল হলো সেই ‘ম্যাজিকাল হেল্পার’, যিনি জানেন সব গেটওয়ে কোন অফিসে কী সময় কাগজপত্র সত্যায়িত হবে, কীভাবে সিলটা বানাবে, সবকিছুই তার জানা।


আপনার মনে হতে পারে, “এতো আর কিছু নয়, অফিসে গিয়ে সোজা কাগজটা সত্যায়ন করিয়ে নিয়ে আসবো।” কিন্তু না, তা না। প্রথমে সিকিউরিটি চেকিং, তারপর দরকার পড়ে কাগজপত্রের নাম্বার জিজ্ঞেস করতে, এরপর সেই নাম্বার নিয়ে সিলের জন্য যুদ্ধ শুরু! কীভাবে? ২০ মিনিটে সিলের জন্য বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এটা যেন কোনো সাইকোলজিক্যাল টেস্টের মতো। ভাববেন, "যদি এমন হতো যে আমার সিলটা মিস্ট্রি বাক্সের মতো থাকত, আমি শুধু ট্যাপ করলে সেটি সত্যায়িত হয়ে যেত!"


আর যদি একেবারে গ্রামে বাস করেন, তবে তো আরও মজা! গ্রামের অফিসে গিয়ে সেই ঐতিহ্যবাহী ‘লাল সিল’ পাওয়া আর পাওয়া না-এটাই একটি মহা কূটনীতি হয়ে দাঁড়ায়। তবে, সৎ পথে যেতে গেলেও, সেখানে অনেকসময় অফিসার থাকেন না, আর যদি থাকেন, তো তিনি ব্যস্ত। তখন আবার আপনাকে হয়তো আবার দালাল খুঁজতে হবে, যিনি বলবেন, "চিন্তা করবেন না, আমি সব ব্যবস্থা করবো, সিল হাতে আসবে একদম ঠান্ডা মাথায়!" আর ঠিক তখনই আপনি ভাববেন, "তাহলে তো সিলের জন্য দালালকে ধরেই ভালো!"


এদিকে, পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার একটাই প্রশ্ন থাকে, “এটা কি সত্যায়ন, নাকি জীবনের মহাকাব্য?” সত্যি কথা বলতে, এই পুরো সত্যায়ন পদ্ধতি এক এলেবেলে নাটক। আপনি মঞ্চে অভিনয় করছেন, আর রিহার্সাল হচ্ছে দিনের পর দিন!


এই সব কিছুর মধ্যেই একটি আশা জমে থাকে, যে একদিন হয়তো কাগজপত্রের সত্যায়ন প্রক্রিয়া ডিজিটাল হবে। একটি ক্লিকেই কাগজপত্র সিল হয়ে যাবে, আর দালালদের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো তখন আপনি আপনার কম্পিউটার স্ক্রীনে দেখে বলবেন, "ও, এত সহজ ছিল! আর দালালের ভয়ে দৌড়ানোর কোন প্রয়োজন ছিল না!"

বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর উদাহরণ

বিশ্বের অনেক দেশেই কাগজপত্রের সত্যায়ন পদ্ধতি ডিজিটাল করা হয়েছে। যেমন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপের বেশ কিছু দেশ এবং কানাডা অনেক আগেই ডিজিটাল সিস্টেমে চলে গেছে। সেখানে, নাগরিকরা ঘরে বসেই তাদের কাগজপত্র সত্যায়ন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে "ई-सील" (E-Seal) নামক একটি সিস্টেম চালু আছে, যেখানে নথিপত্রগুলি অনলাইনে আপলোড করে সিল প্রাপ্তি সম্ভব। দক্ষিণ কোরিয়াতেও তারা অনলাইন এবং মোবাইল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাগজপত্রের সত্যায়ন করে থাকে, যা দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরও সুশৃঙ্খল ও দ্রুততর করে তোলে।


বাংলাদেশের জন্য পথ দেখানো

বাংলাদেশেও এই ধরণের ডিজিটাল সিস্টেম চালু হলে, সরকারের ব্যস্ত দফতরের চাপ কমবে এবং নাগরিকরা আরও সহজভাবে তাদের কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন। ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে কাগজপত্রের সত্যায়ন সরাসরি সরকারি সার্ভারে রেকর্ড হবে, যা নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খল হবে। এর মাধ্যমে জনসাধারণের জন্য একটি স্বচ্ছ, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত সময় এবং অর্থের অপচয় কমে যাবে, এবং জনগণের উপর থেকে দুর্নীতির ছায়া দূর হবে।


উপসংহার

বাংলাদেশে কাগজপত্রের সত্যায়ন প্রক্রিয়া আজও এক পুরনো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা নাগরিকদের জন্য এক গভীর বিপদসংকুল অবস্থার সৃষ্টি করে। তবে, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আধুনিক পদ্ধতির গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সরকারের উদ্যোগে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হলে, কাগজপত্রের সত্যায়ন প্রক্রিয়া সহজ, দ্রুত এবং দুর্নীতিমুক্ত হবে। সেই দিনটি আশা করা যায়, যখন কাগজপত্রের সত্যায়ন আর এক ভোগান্তির নাম হবে না, বরং এটি একটি দ্রুত, স্বচ্ছ এবং নাগরিকবান্ধব প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে।


তবে প্রশ্ন রয়ে যায় কবে সেই দিন আসবে, যখন কাগজপত্রের সত্যায়ন আর কোনো ভোগান্তির নাম হবে না?


- তুহিন সারোয়ার।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলাদেশে এক রহস্যময় বাহিনী, যার অস্তিত্ব সাধারণ জনগণের কাছে প্রায় অজানা

International Journalists from Bangladesh

চোরের দশদিন আর পালানোর একদিন